আপনি কি কখনও এমন কোনও জানালার সামনে দাঁড়িয়েছেন, যেটা দিনের বেলায়ও অন্ধকারে ডুবে থাকে?
যেটা থেকে আলো নয়… বরং অন্ধকারই বেরিয়ে আসে…
আজ আমি আপনাদের শোনাবো এক এমন বাড়ির গল্প… যেখানে একটা কালো জানালা… ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয়… যারাই ওর দিকে তাকিয়েছে…
আমার নাম সৌম্য। পেশায় ফটোগ্রাফার। দু’মাস আগে একটা ফটোশুটের জন্য আমাকে যেতে হয়েছিল উত্তরবঙ্গের এক পুরোনো রাজবাড়িতে। বাড়িটা এখন প্রায় ভাঙাচোরা, তবে এক লোক সেটাকে ভাড়া নিয়ে রিসোর্ট বানানোর চেষ্টা করছে।
লোকটার নাম অম্লান সেন। উনি ফোনে বলেছিলেন, “বাড়িটা পুরনো হলেও লোকেশনটা অসাধারণ। তবে… একটু অদ্ভুত ব্যাপার আছে… আপনি ভয় পাবেন না তো?”
আমি হেসে বলেছিলাম, “ভূত-টুতের ভয় আমার নেই। কাজটাই ভয়ের—পেমেন্ট সময়মতো না পাওয়া!”
ট্রেনে করে পৌঁছলাম জলপাইগুড়ি, সেখান থেকে জিপে প্রায় এক ঘণ্টা। চারিদিকে চা-বাগান, মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই রাজবাড়ি—দু’তলা, লাল ইট, কালো হয়ে যাওয়া বারান্দা।
বাড়ির উত্তর দিকের এক জানালা আমার নজর কাড়ল—একমাত্র সেই জানালাটা পুরো কালো। অন্য সব জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকছে, কিন্তু ওইটায় কিছুই নেই—শুধু কালি-কালো শূন্যতা।
অম্লানবাবু বললেন,
—“ওই ঘরটা ব্যবহার হয় না।”
—“কেন?”
—“…আপনি রাতে ওটার দিকে তাকাবেন না, তাহলেই হবে।”
আমি ভেবেছিলাম, এইসব গ্রামীণ কুসংস্কার।
শুটিং সারতে সারতে রাত ন’টা বাজে। লাইট গুটিয়ে ঘরে ঢুকলাম। তখনই লক্ষ্য করলাম, আমার ঘরের জানালা থেকে ওই কালো জানালাটা সোজা দেখা যায়।
রাতে, বাকি বাড়ি অন্ধকার হলেও, ওই জানালার কালো যেন আরও ঘন হয়ে উঠেছে।
ক্যামেরা হাতে নিয়ে জুম করতেই হঠাৎ মনে হল… ওই কালোর মধ্যে কারও চোখ ঝলসে উঠল।
আমি চমকে উঠলাম। আবার দেখলাম—কিছুই নেই।
নিজেকে বললাম, “আলো আর ছায়ার খেলা।” কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন একটা ঠান্ডা ভাব জমে গেল।
সেদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে থেকে আসছে হালকা টোকা দেওয়ার শব্দ—টুপ… টুপ…
জানালার বাইরে তাকাতেই দেখলাম—ওই কালো জানালার সামনে… সাদা শাড়ি পরা এক মহিলা দাঁড়িয়ে।
মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু চুল এলোমেলো, হাতে কিছু নাড়ছে—একটা ঘণ্টা।
প্রতি টুপ শব্দে ঘণ্টাটা কাঁপছে।
আমি চোখ মুছে আবার তাকালাম—ফাঁকা। জানালাটা আবার শুধু কালো।
পরের দিন সকালে আর সহ্য হলো না। আমি অম্লানবাবুকে বললাম, “আপনি আসল কথা বলুন।”
তিনি একটু চুপ করে থেকে বললেন—
“এই জানালার ঘরটা ছিল রানীমায়ের শয়নকক্ষ। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এক ঝড়ের রাতে উনি ওখানে আত্মহত্যা করেন—গলায় ফাঁস দিয়ে। তখন থেকে রাত হলে লোকজন বলে, উনি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন।
যে-ই তাঁর চোখের দিকে তাকায়… সে কয়েক দিনের মধ্যে পাগল হয়ে যায়… তারপর…”
“তারপর?”—আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি চোখ নামিয়ে বললেন—“মরে যায়।”
আমি এসব বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু সেই রাতে কিছু অদ্ভুত হল।
বাতাস থেমে গেছে, বাড়ি যেন নিঃশ্বাস ফেলছে না। হঠাৎ বাইরে ঘণ্টার শব্দ—টুপ… টুপ…
আমি ক্যামেরা হাতে জানালার দিকে তাকালাম—
কালো জানালায় এবার পুরো মুখ দেখা যাচ্ছে—ফ্যাকাসে, চোখদুটো লাল, ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি।
তিনি হাত দিয়ে ইশারা করলেন—“এসো…”
আমি যেন অবশ হয়ে গেলাম। পা এগিয়ে যাচ্ছিলো… ধীরে ধীরে… বারান্দার দিকে…
শেষবার মনে পড়ে—আমি হাত বাড়িয়ে জানালার কালোতে ছুঁয়েছিলাম।
এখন এই গল্পটা আমি কোথা থেকে বলছি, জানেন?
হ্যাঁ… ওই কালো জানালার ভেতর থেকে।
আর আপনি তো বেশ মন দিয়ে শুনলেন… তাই না?
আজ রাতের মধ্যে… আপনি-ও একবার জানালার দিকে তাকিয়ে নেবেন…
0 Comments